অশান্ত ভারতের ভবিষ্যৎ কোনদিকে?
১২ ডিসেম্বর ভারতের সংসদে পাস হওয়ার পর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে সই করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ বিল পরিণত হয়েছে আইনে৷ এই নতুন আইন প্রণয়নের পর থেকেই জ্বলছে ভারত৷ আইনটি সাম্প্রদায়িক, এই যুক্তিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ, যার বেশির ভাগই আসছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে৷
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বাড়ছে পুলিশের উপস্থিতি৷ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা ছাত্রদের ওপর এদিকে পুলিশি সহিংসতার নিন্দা করছেন সমাজের একাংশ৷ কিন্তু ছাত্রদের ওপর এই নির্মমতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কোথাও একটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রতিবাদের মূলে থাকা সদ্য পাশ হওয়া আইনের মৌলিক সাম্প্রদায়িক কাঠামো৷ অন্যদিকে, সমাজের একটা বিরাট অংশ পুলিশের ভূমিকাকে দেখছেন রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই৷ এর সাথে, কেরালা, পাঞ্জাব, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গসহ রাজ্যগুলির এই আইন-বিরোধী অবস্থানের ফলে ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, তা নিয়েও থাকছে যথেষ্ট সংশয়৷
এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে দাখিল হওয়া পিটিশনের শুনানির কাজ শুরু হবে৷
কিন্তু অন্যদিকে, আক্রান্ত ক্যাম্পাসগুলোর সাবেক থেকে বর্তমান সব ছাত্রের মধ্যেই ঘনীভূত হচ্ছে ক্ষোভ৷ দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বাইয়ের টাটা ইন্স্টিটিউট অফ সোশাল সায়েন্সেস, আসামের জোরহাট বিশ্ববিদ্যালয়, চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অসংখ্য ক্যাম্পাস থেকে সংগঠিত হয়েছে অসংখ্য প্রতিবাদ কর্মসূচি৷
এছাড়া, শনিবার গভীর রাতেও নাগরিক প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়সহ বিভিন্ন রাজ্যে৷ যান চলাচল ব্যাহত হওয়া ছাড়াও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে দেশজুড়ে আহত শতাধিক৷ প্রাণও হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷
কিন্তু খবরের শিরোনামে রয়েছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি সহিংসতাই, যার ফলে শক্তিশালী হচ্ছে নতুন আইনবিরোধী বিক্ষোভ৷
ভারতীয় সাংবাদিক ও সমাজকর্মী নেহা দিক্ষিত একটি টুইটে শেয়ার করেন একটি ভিডিও৷ সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে পুলিশ৷ ভাঙা হয়েছে বাথরুমের কাচ, মেরে অচৈতন্য করে দেওয়া হয়েছে বহু ছাত্রদের৷
শুধু তাই নয়, তাক করে রাখা বন্দুকের মুখে সারি বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বের করে আনা হয়েছে ছাত্রদের৷ এই চিত্র সোশাল মিডিয়ায় আসার পর থেকেই আলোচিত হচ্ছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদ৷ প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত নেই সমাজের বিশিষ্টজনেরাও৷
ইতিমধ্যে, আটক করা হয়েছে জামিয়া মিলিয়ার প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে৷ ফলে, আরও জোর পাচ্ছে দেশজুড়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ৷ ইন্টারনেট বন্ধ, তবুও থামছে না সোশাল মিডিয়া ঝড়।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হয়ে আইনে পরিণত হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে আইনের পক্ষ-বিপক্ষ মতামতের ঢল, যার বেশি ভাগই উপচে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে৷ ইতিমধ্যে, ভারতের ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা৷ কিন্তু তবুও থামানো যাচ্ছে না প্রতিবাদী জনতাকে৷
এদিকে, ফেসবুকে রাষ্ট্রের পক্ষে দল ভারী করতে শুরু হয়েছে ‘আই সাপোর্ট সিএবি’ (আমি সিএবি বিল সমর্থন করি) স্লোগানের ‘ফিল্টার’৷ অন্যদিকে, টুইটারে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পাল্টা ‘নো এনআরসি’, ‘নো সিএবি’ ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ৷ এই ‘ট্রেন্ড’ থেকে দূরে নেই সমাজের বিশিষ্টজনেরাও৷
ক্রিকেটার ইরফান পাঠান একটি টুইটে জামিয়া মিলিয়ার প্রতিবাদী ছাত্রদের পক্ষে তার অবস্থান জানান৷ একইভাবে পুলিশি সহিংতার নিন্দা করে টুইট করেন অভিনেত্রী ও চিত্র পরিচালক কঙ্কনা সেনশর্মাও৷
এছাড়াও, নতুন করে আলোচনায় উঠে আসছে লেখক চেতন ভগতের টুইটগুলো৷ ২০১৪ সালের পর থেকেই চেতন ভগত পরিচিত হয়ে ওঠেন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষের অনলাইন সমর্থক হিসাবে৷ শুধু অনলাইন নয়, বিভিন্ন টকশোতেও তাকে দেখা যায় সরকারের পক্ষে তর্কে নামতে৷ এমন কট্টর সরকারপন্থি হিসাবে জনপ্রিয় চেতন ভগত গত দু’দিনে বেশ কয়েকটি টুইটে এই আইনের প্রণয়ন পরবর্তী সময়ে সরকারের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন৷
এইখানেই না থেমে, কড়া ভাষায় সরকারের মুসলিমবিরোধিতার সমালোচনা করে আরেকটি টুইট করেন তিনি৷
রবিবার ভারতের দুমকা শহরে একটি সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘প্রতিবাদী মানুষদের পোশাকের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঠিক কারার রাস্তায় নেমেছেন৷’ প্রধানমন্ত্রীর এই তীর্যক বক্তব্যকে অনেকে দেখছেন মুসলমানদের প্রকাশ্য প্রতিবাদের ওপর সরাসরি তোপ হিসাবে৷ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যেরও নিন্দা উঠে আসছে সোশাল মিডিয়ায়৷
অন্যদিকে, প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর পুলিশি লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, হাতাহাতি ও সরকারের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ সব মিলিয়ে বর্তমান ভারতের অবস্থা খুবই সংকটজনক৷ রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে থাকার আশ্বাস দেওয়া হলেও রাস্তার চিত্র তা জানাচ্ছে না৷
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামবে বলে জানিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) দলের যুব বিভাগ গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন৷ কিন্তু চলমান এই প্রতিবাদের ধারা থেকে কীভাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে ঠেকানো সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়৷ ফলে, বর্তমান বিক্ষোভের সাথে কীভাবে বাম-ডান সব রাজনৈতিক দল নিজেদের বৃহত্তর উদ্দেশ্যগুলোকে যুক্ত করে, তাই এখন দেখার বিষয়৷-ডয়চে ভেলে