ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথ বেয়েই অর্জিত হয় মাতৃভাষা

 রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস। ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথ বেয়েই অর্জিত হয় মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং এরই ধারাবাহিকতায় আসে বাঙালির চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে তিনি এ কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণ ও জাতিগোষ্ঠীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।

তিনি বলেন, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে এ দিবসটি উদযাপন এক অনন্য উদ্যোগ। মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে জীবন উৎসর্গকারী ভাষা শহীদ রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহীদদের তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন, যিনি ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষার দাবিতে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্মরণ করেন, যিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ধরেন। সকল ভাষা সংগ্রামীকে স্মরণ করেন, যাদের দূরদৃষ্টি, অসীম ত্যাগ, সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাঙালি পায় মাতৃভাষার অধিকার।

আবদুল হামিদ বলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রক্ষারও আন্দোলন। অমর একুশের অবিনাশী চেতনা-ই দেশের জনগণকে স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অফুরন্ত প্রেরণা ও অসীম সাহস জুগিয়েছে।

তিনি বলেন, ভাষা ও সংস্কৃতি মানবজাতির অমূল্য সম্পদ। এটি মহাকালকে যেমন ধারণ করে, তেমনি মানব ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় জীবনধারাকে প্রবাহমান রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। দারিদ্র্য, সাম্রাজ্যবাদ, বাণিজ্যবাদ, ধর্মপ্রচার, অভিবাসন, উদ্দেশ্যমূলক আর্থিক ও মানবিক সহযোগিতা, ভাষার উপযুক্ত চর্চার অভাব, জনসংখ্যা হ্রাস, পরিবেশের অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতিসহ নানা কারণে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো ভাষার বিলুপ্তি ঘটছে। ভাষার বিলুপ্তি মানে এক একটা সংস্কৃতির বিলোপ, জাতিসত্তার বিলোপ, সভ্যতার অপমৃত্যু। মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ বিশ্বে বিরল ঘটনা। ১৯৯৯ সালে কয়েকজন মাতৃভাষাপ্রেমী প্রবাসী বাঙালির প্রাথমিক উদ্যোগ এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও ঐকান্তিক চেষ্টায় জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ ছিল বাঙালি হিসেবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বিশ্বের বিকাশমান ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় গবেষণার জন্য ২০০১ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নে তাদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিজস্ব মাতৃভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ইতিবাচক অবদান রাখবে।

তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা আজ অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস। এ চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর নানা ভাষাভাষী মানুষের সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হোক, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো আপন মহিমায় নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে উজ্জীবিত হোক, গড়ে উঠুক নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য বিশ্ব- মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ কামনা করি।

 

আরও