বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি: ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট

গাজীপুরের নরসিংহপুর মৌজার আড়াইশ’ শতাংশ জমি মর্টগেজ রেখে মেসার্স খাদিজা অ্যান্ড সন্স ২৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বেসিক ব্যাংক থেকে।

প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. শামীম আহসান জমির মালিকানার দলিল জামানত হিসেবে ব্যাংকটির গুলশান শাখায় জমা দেন। কিন্তু জনৈক এ মজিদ একই জমির মালিকানা দাবি করে ওই শাখায় একটি অভিযোগ জমা দেন। পরে খাদিজা অ্যান্ড সন্সের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ জমি ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়।

একইভাবে ভুয়া জমি বন্ধক রেখে প্রায় ১১ কোটি টাকা ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে মেসার্স সিমেক্স লিমিটেড। দিলকুশা শাখায় এ জালিয়াতির ঘটনা ধরে পড়ে।

শুধু খাদিজা অ্যান্ড সন্স ও সিমেক্স লিমিটেডই নয়, আরও কমপক্ষে ২৬টি প্রতিষ্ঠান ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার (৩ হাজার ৮৮৫ কোটি) টাকা লুটপাট করেছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে।

দুর্নীতির ধরন প্রসঙ্গে সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি খাস জমিকে বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বেসিক ব্যাংকে। শুধুতাই নয় বন্ধকী জমি আইনজীবী কর্তৃক ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও গ্রাহককে ঋণ দেয়া হয়েছে।

এমনকি ঋণ ইস্যু করা হয় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতেও। এছাড়া ঋণ শোধের যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভুয়া বন্ধকী নিয়ে ঋণ দেয়া, পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণ, শ্রেণিকৃত দায় থাকার পরও ত্রুটিপূর্ণ সহায়ক জামানতের বিপরীতে এবং গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ঋণ দেয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এমএ মজিদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকের পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। বড় ধরনের কোনো অডিট আপত্তি হয়নি। আমি অডিট রিপোর্ট এখন পর্যন্ত দেখিনি। ধারণা করছি, এসব ঋণ দেয়া হয়েছে আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে। অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী এর জবাব দেয়া হবে।

অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু যোগদান এবং ব্যাংক থেকে বের হওয়া পর্যন্ত এসব অনিময় হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের আগের অবস্থা ভালো ছিল। এরপরও বলা হচ্ছে, আবদুল হাই বাচ্চুর সময় অনিয়মের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বাচ্চুর সঙ্গে রাষ্ট্রের শক্তিশালী ব্যক্তির যোগাযোগ আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না কেউ। এজন্য দরকার সাবেক চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করে তার নেপথ্যের শক্তিশালী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে এ ধরনের অনিয়ম প্রমাণ করে ব্যাংকিং খাতে কেমন দুর্নীতি হচ্ছে। এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন ফেলে রাখা যাবে না। এ অনিয়মের বিষয়গুলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় আনতে হবে। এরপর সেখানে দুর্নীতি ধরা পড়লে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে- সমুদ্রগ্রামী জাহাজ কেনার জন্য দিলকুশা শাখার একজন নতুন গ্রাহক মেসার্স বে-নেভিগেশন লি. কে প্রায় ৭২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া।

জাহাজ ব্যবসা মনিটরিং করা কঠিন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি- এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হলেও ব্যাংকটির ওই শাখা থেকে ঋণ বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি এ ঋণের বিপরীতে কোনো ধরনের জমি ও ভবন জামানত হিসেবে নেয়া হয়নি। ক্রয়কৃত জাহাজের প্রকৃত মূল্যও যাচাই করেনি ব্যাংক।

অপর এক ঘটনায় দেখা গেছে, মেসার্স আ কে ফুডস লিমিটেডক ঋণ দেয়ার ব্যাপারে দিলকুশা শাখা থেকে কোনো সুপারিশ করেনি। ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত ও ঋণ দেয়ার পক্ষে কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে না পাওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৬৪ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়।

এছাড়া মেসার্স এ্যাপোলো ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশনকে ৫৬ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়। মূলত আমদানিকৃত মালামাল বিক্রি ও ব্যবহার করে ৯০ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু এ ঋণের মেয়াদ ২ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যা নিয়মবহির্ভূতভাবে মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ গ্রাহকের ঋণ শ্রেণিকৃত বা খেলাপি হয়ে পড়েছে।

অনিয়মের বিবরণে সিএজির অডিট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রিমিয়ার ও ঢাকা ব্যাংকের গ্রাহক মেসার্স আবিদ ডাইং মিলস লিমিটেড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়েল টেক্স, ওয়েল সোয়েটার কোম্পানির কাছে ৬০ কোটি টাকার ঋণের অর্থ পাওনা ছিল।

এটি পরিশোধ করে টেকওভার করে নেয় বেসিক ব্যাংক। পাশাপাশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ ১ বছরের স্থানে ২ বছর নির্ধারণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।

এছাড়া মেসার্স নিউ অটো ডিজাইন ৮৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়েছে বেসিক ব্যাংকের। এ গ্রাহকের স্বামীর প্রতিষ্ঠান একক ঋণসীমা অতিক্রম করবে বিধায় স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠানের নামে এ ঋণ নেয়া হয়।

এ ঋণের বিপরীতে মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট ও হরিরামপুরে জমি জামানত হিসেবে জমা দেয়া হয় অতি মূল্যায়ন করে। যা পরে প্রমান হণ। এ ঋণ নেয়ার পর গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হয়।

অন্যসব অনিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি হচ্ছে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ৫৬ কোটি টাকার ঋণ ইস্যু, নিয়ন্ত্রণহীন এলাকার বাইরে তড়িঘড়ি করে ৩৩ কোটি টাকার মঞ্জুর, শাখার আপত্তি উপেক্ষা ও বন্ধকী সম্পত্তি মূল্যায়ন ছাড়া ৬৪ কোটি টাকার ঋণ ইস্যু, মঞ্জুরি শর্ত অমান্য করে অনিয়মিতভাবে ৬০ কোটি টাকার ওডি ঋণ বিতরণ করা।

এছাড়া ১৯ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হলেও ওই টাকা নিয়ে অন্য ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ পরিশোধ করা হয়। অর্থাৎ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয় ঋণের টাকা। অনিয়মে আরও রয়েছে সুষ্ঠু যাচাই ছাড়া ৩৬ কোটি টাকার এসওডি ঋণ বিতরণ, অপ্রতুল জামানতের বিপরীতে ৭২ কোটি টাকার ঋণ ইস্যু করা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও বৈদেশিক ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন, আর্থিক বিধি-বিধান ও সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে আদেশ অমান্য করা হয়েছে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নিরীক্ষা কার্যক্রম দুর্বল থাকার কারণেই মূলত উল্লিখিত সব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।

আরও