দিল্লির দাঙ্গায় ব্যতিক্রম মুস্তফাবাদ, মুসলিমদের ঘরে হিন্দুরা
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে। সহিংসতা-সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৪ জন, আগুন দেয়া হয়েছে একাধিক মসজিদে। বেশিরভাগ এলাকায় বেছে বেছে মুসলিমদের ওপরই হামলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম মুস্তফাবাদ। এ এলাকায় হিন্দু-মুসলিম হাতে হাত রেখেই দাঙ্গাকারীদের প্রতিরোধ করছেন স্থানীয়রা।
মুস্তফাবাদের প্রধান সড়কগুলোর বেশিরভাগই প্রায় জনশূন্য, ঘোরাফেরা করছেন কিছু পুলিশ-সিআরপিএফ সদস্য। ১৪৪ ধারা জারি করায় কাউকে দেখামাত্রই গুলি করার অনুমতি রয়েছে তাদের।
তবে অলিগলিতে স্থানীয়দের দেখা মিলছে কিছুটা। বাইরে দাঁড়িয়ে তারা সতর্ক নজর রাখছেন, যেন কেউ হামলা না চালায়।
পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এক ব্যক্তি বলেন, অবস্থা তো কিছু লোকই খারাপ করে রেখেছে। আমরা চেষ্টা করছি না ওদিক (হিন্দু) থেকে হিংসা থাক, না এদিক (মুসলিম) থেকে।
পাশের একটি বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেন, দেখুন, ওটা মুসলিমদের বাড়ি। কিন্তু সেখানে তিন দিন ধরে এক ব্রাহ্মণ মেয়ে থাকছে।
জানা যায়, ওই বাড়ির মালিকের নাম মোহাম্মদ আরশাদ খান। দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকেই সেখানে সোনিয়া স্বামী নামে এক হিন্দু মেয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
আমবেদকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সোনিয়া বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সময় আমি কলেজেই ছিলাম। আমার সহপাঠী ও বন্ধু শামা জানতে চায়, আমি তাদের বাড়ি আসব কি না। কারণ এটাই ছিল কলেজ থেকে সবচেয়ে কাছের নিরাপদ জায়গা।
শামা মালিক বলেন, সে (সোনিয়া) শিব বিহারে থাকে। ওই সময় তার এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। আমি চাচ্ছিলাম, সে নিরাপদে থাক। এজন্যই তাকে সঙ্গে নিয়ে আসি। বিপদে থাকবে জেনেও কীভাবে আমার বন্ধুকে রেখে আসতাম?
সোনিয়া বলেন, আমার বাবা-মা প্রথমে চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু যখন শুনেছেন আমি শামাদের বাড়িতে, তারপর শান্ত হয়েছেন।
শুধু এটাই নয়, মুস্তফাবাদে সম্প্রীতির উদাহরণ আরও আছে। শামাদের বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরেই পরপর তিনটি হিন্দু বাড়ি।
মোহাম্মদ ইরফান নামে এক ব্যক্তি বলেন, এলাকায় দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি দেখার পর থেকেই তারা (হিন্দু) খুব ভয়ে ছিল। আমি বলেছি, কোনও ভয় নেই, আমি তোমাদের পাশে আছি, তোমাদের দায়িত্ব আমার। তোমরা আমার প্রতিবেশী, আমি তোমাদের খেয়াল রাখবো।
মনু নামে ওই এলাকার হিন্দু ধর্মানুসারী এক বাসিন্দা বলেন, আমরা গত রাতে খুব আতঙ্কে ছিলাম। গুলি হচ্ছিল, ইটপাটকেল মারছিল, বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। সেই সময় বন্ধু ইমরানসহ কিছু লোক আমাদের সাহস দেয় ও সেখান থেকে সরে আসতে সাহায্য করে। তারা মানবতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। একদিকে মানুষ পাথর মেরেছে, সহিংসতায় মেতেছে; অন্যদিকে তারা (মুসলিম) ভিন্ন সম্প্রদায়ের হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সময়ে আমাদের সাহায্য করেছে।
শুধু মুসলিমরাই নয়, দাঙ্গার মধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন হিন্দুরাও। হরজিৎ ভাটি নামে এক চিকিৎসক জানান, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর শ্যামবিহার এলাকায় অন্তত ২৫টি মুসলিম পরিবার হিন্দুদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে বুধবার মুস্তফাবাদ হাসপাতালে নিয়ে আসে।
ওই পরিবারগুলোর এক সদস্য বলেন, আমরা এখনও বেঁচে আছি। কারণ হিন্দু প্রতিবেশীরা আরএসএস গুন্ডাদের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। সবাই জানে এ দাঙ্গার পেছনে কারা আছে। আরএসএস-বিজেপিকে চপেটাঘাত করা এ ভারত নিয়ে আমি গর্বিত।
গত রোববার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) সমর্থকবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বৃহস্পতিবারও অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। এছাড়া আহত হয়েছে আরও দুই শতাধিক মানুষ।
সহিংসতার ঘটনার তিনদিন পর বুধবার এ বিষয়ে প্রথমবার মুখ খুলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সহিংসতাপূর্ণ এলাকায় শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।