কবি নির্মেলেন্দু গুণের কবি বঙ্গবন্ধু
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনতে সেদিন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সমবেত হয়েছিল ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে।
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়। দুপুরের মধ্যেই তিলধারণের জায়গা ছিল না। মানুষের ঢল রেসকোর্স ময়দান পেরিয়ে রাস্তা পর্যন্ত চলে যায়।
সেদিন ওই জনসমুদ্রে উপস্থিত ছিলেন একজন তরুণ কবি ও সাংবাদিক। ২৬ বছর বয়সী নির্মলেন্দু গুণ তখন দ্য ডেইলি পিপল পত্রিকায় শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেদিন রেসকোর্সে গিয়েছিলেন তিনি। মঞ্চের একেবারে সামনের সারিতে সাংবাদিকদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসেন নির্মলেন্দু গুণ। ভিড় ঠেলে সেই আসনটি পেতে তাকে সাহায্য করেছিলেন সাপ্তাহিক পত্রিকা গণবাংলার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানাচ্ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। ৭৫ বছর বয়সী কবি দিনটির কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, সেটা ছিল শিহরণ জাগানোর মতো ভাষণ।
অন্যান্যদের মতো তিনি নিজেও সেদিন বক্তব্য শোনার জন্য ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। সেদিনের ওই ভাষণই পরবর্তীতে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
৭ মার্চের স্মৃতিকে তিনি বন্দী করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আত্মজীবনীগ্রন্থ আত্মকথা ১৯৭১ এ।
লিখেছেন, একসময় মঞ্চে আসেন বঙ্গবন্ধু। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা এবং হাতকাটা কালো কোট। বিকেল সোয়া তিনটার দিকে মঞ্চে ওঠেন তিনি।
জয় বাংলা!
উপস্থিত লাখো জনতাকে অভ্যর্থনা জানান তিনি। উত্তরে বিশাল জনতাও একসঙ্গে জয় বাংলা বলে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু বলতে শুরু করলেন, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়…
নির্মলেন্দু গুণ বলেন, আমি এ ধরনের শব্দচয়ন আর কখনো শুনিনি। জীবদ্দশায় আর কখনো শোনার সুযোগও হবে না। এটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো একটা ভাষণ।
৭ মার্চ ভাষণের অনুপ্রেরণা থেকেই নির্মলেন্দু গুণ রচনা করেছেন তার অন্যতম সমাদৃত কবিতা স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল। কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে কবি হিসেবে সম্বোধন করেছেন তিনি। লিখেছেন, গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি।
স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি নির্মলেন্দু গুণ মনে করেন ১০৩ লাইনের এই ভাষণের বক্তাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কোথাও লেখা ছিল না। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। মনে হচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুর ভেতর থেকে কেউ একজন শব্দের পর শব্দ সাঁজিয়ে তাঁর কণ্ঠে পৌঁছে দিচ্ছেন। আর এ কারণেই কবিতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে কবি সম্বোধন করেছি। লিখেছি, লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: কখন আসবে কবি?
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই অন্ততকাল বেঁচে থাকবেন বলে মনে করেন নির্মলেন্দু গুণ।
৭ মার্চ নিয়ে আমার লেখা কবিতার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ যে চিরকাল মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে ভাষণটি অনেকটা রাজনৈতিক কবিতার মতো। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ভাষণ বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ।
অনেকেই এই ভাষণকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন।
নির্মলেন্দু গুণ এই প্রসঙ্গে বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে গেটিসবার্গের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি অনেক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য শুনেছি কিন্তু এটা আমাকে বলতেই হবে যে, বঙ্গবন্ধুর তুলনায় নিপুণ, সুন্দর ভাষণ আর কেউই দিতে পারেননি।
আত্মকথা ১৯৭১ থেকে জানা যায়, সেসময় সাপ্তাহিক গণবাংলা পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে একটি টেলিগ্রাম প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অফিসে গিয়ে নির্মলেন্দু গুণ ভাষণের শেষ দুই লাইন শিরোনামে রেখে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন।
প্রতিবেদনটি পড়ার পর জাহিদ ভাই (আনোয়ার জাহিদ) হেসে আমাকে জিগ্যেস করলেন, শেখ সাহেব যে চারটি শর্ত দিয়েছেন সেটা কি তুমি খেয়াল করোনি? আমি জিগ্যেস করলাম, কবে? কখন?
আনোয়ার জাহিদ তখন নির্মলেন্দু গুণকে টেলেগ্রামের পরিবর্তে একটি কবিতা লিখতে বলেন। নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতাটি সেসময় গণবাংলায় প্রকাশিত হয়। তবে, সেই কবিতা এখন প্রায় বিস্মৃত। আর কোনো কপিও নেই কারো কাছে।
১৯৭৯ সালে নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে লালন করার তাগিদ থেকেই কবিতাটি লিখেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ।
তিনি বলেন, আমি এমন একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম যেটা পড়ে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে জানতে পারে, ওই ভাষণটি উপলব্ধি করতে পারে।
ময়মনসিংহের বাড়িতে বসে বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণকে কবিতাটি প্রথম শুনিয়েছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। বাবা বলেছিল, কবিতাটি শুনে তিনি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে পারছেন। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে কবিতাটি স্বার্থক, আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
১৯৮০ সালে কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় । পরে, ১৯৮১ সালে চাষাভূষার কাব্য -এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়।