মুজিববর্ষে অবহেলিত বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কিছু মানুষ
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী সমাগত প্রায়। ৭ মার্চ হলো জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর আগে সবচেয়ে বড় একটি দিবস। এইদিনেই বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সেরা ভাষণটি দিয়েছিলেন। এই ভাষণটি সর্বকালের সেরা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক। মুজিববর্ষের আয়োজন এরই মধ্যে নানা সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে। অনেকেই বলছেন যে অতিমাত্রায় আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে এই মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা।
যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেন, যারা রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারা বলছেন যে মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর যারা প্রিয় মানুষ ছিল, তাদেরকে যদি পাদপ্রদীপে আনা হতো, তাহলে তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতার স্মৃতিচারণ এবং জাতির পিতাকে তরুণ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য তাদের মেধা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগালে মুজিববর্ষ পূর্ণতা পেতো। কিন্তু জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ অনেকেই মুজিববর্ষে অবহেলিত, উপেক্ষিত, অপাঙক্তেয়;
তোফায়েল আহমেদ
জাতির পিতার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন রাজনীতিবিদ মনে করা হতো তোফায়েল আহমেদকে। বঙ্গবন্ধু তাকে তার রাজনৈতিক সচিব বানিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই থাকতেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর অনেকেই তোফায়েল আহমেদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা ঠেকাতে তিনি যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি, এমন অভিযোগও করেন। কিন্তু এসব অভিযোগ পাশে রেখেও বলা যেতে পারে যে তোফায়েল আহমেদ রাজনীতিবিদদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
কিন্তু এই মুজিববর্ষে তোফায়েল আহমেদ উপেক্ষিত। যদিও তিনি কমিটিতে রয়েছেন। কিন্তু মুজিববর্ষের মূল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি কতটা সক্রিয়, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।
আ স ম আব্দুর রব
যদিও জাসদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরপরই আ স ম আব্দুর রব বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক সমালোচনাও তিনি করেছিলেন। অনেক রাজনৈতিকবোদ্ধা মনে করেন, জাতির পিতার হত্যার পটভূমি তৈরি করার ক্ষেত্রে জাসদের অনেক বড় একটা ভূমিকা ছিল। এতকিছু সত্ত্বেও আব্দুর রব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া ছাত্রনেতাদের একজন। বঙ্গবন্ধু তাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছাপিয়েও আ স ম আব্দুর রবের মতো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে অনেক তথ্য মুজিববর্ষকে সমৃদ্ধ করতো বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু পশ্নে কোনো পদস্খলন নেই। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। নানা রাজনৈতিক বাঁকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এখন আওয়ামী লীগে নেই, তিনি দল থেকে দূরে। আওয়ামী লীগের নেতারাও মনে করেন যে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কোনো বিচ্যুতি নেই। এমন একটি মানুষকেও এবার মুজিববর্ষে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন
ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগের মাঝেই এখন তিনি অন্যতম সমালোচনাকারী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হয় যে ড. কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তাকে তিনি সংবিধান প্রণয়নের জন্য মুখ্যদায়িত্বও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এখনো জাতির পিতার প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসায় তার কোনো খাদ নেই বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেই কামাল হোসেনও এবার মুজিববর্ষের আয়োজনে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নেই।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে আবিস্কার করেছিলেনই বঙ্গবন্ধু। সেই বঙ্গবন্ধুর কথাতেই শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন পর্যন্ত যারা গবেষণা করেছিলেন, তাদের মধ্যে আবু সাইয়িদ একজন। এ বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়ক অনেক গ্রন্থেরও লেখক তিনি। তার অনেক বিচ্যুতি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তিনি একটি তথ্যভাণ্ডার। মুজিববর্ষে তাকেও কাজে লাগানো হয়নি।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান
অধ্যাপক রেহমান সোবহান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় অধ্যাপকদের মধ্যে অন্যতম। ছয়দফা প্রণয়নে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহানও এবার আলোচনার বাইরে, উপেক্ষিত হয়েই রয়েছেন।
মুজিববর্ষ নিয়ে সবসময়ই বলা হচ্ছে যে জাতির পিতা দলমতের উর্ধ্বে ছিলেন। মুজিববর্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সম্পন্ন করা দরকার। তাহলে যারা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানুষ ছিলেন, তারা কেন মুজিববর্ষে উপেক্ষিত- সেই প্রশ্ন উঠেছে।