জনশূন্য এই ভেনিস কে কবে দেখেছে!
ইতালিতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। তখন ভেনিসের ঐতিহাসিক কার্নিভাল উৎসব চলছিল। চারপাশে মানুষের গিজগিজ। সবাই উৎসবমুখর। উথলপাথল আনন্দ-উল্লাসের রঙ মেখে সবাই যেনো সং সাজার চেষ্টায় মত্ত। ঠিক এমনই একটা মুহূর্তে খবর বেরুলো ইতালিতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
ভেনিস ও মিলান ঘেঁষা শহরগুলোতে কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট পালটে গেলো। কারো মুখে হাসি নেই। চতুর্দিকে এক অজানা আতঙ্কের কালো ছায়া ঘিরে ধরলো। স্থানীয় সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কার্নিভাল উৎসব বন্ধ ঘোষণা করলো। স্কুল-কলেজে ছুটি দেওয়া হলো এক সপ্তাহ। পিঁপড়ের সারির মতো টুরিস্টরা ভেনিস ছাড়তে শুরু করলো। মাত্র দুদিনের মাথায় উৎসব মুখরিত ভেনিস বিরানভূমিতে পরিণত হলো। কোনো পর্যটক নেই। কেউ নেই। জনমানবহীন এমন ভেনিস আগে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না।
যারা ভেনিস দেখেছেন বা গল্প শুনেছেন তারা সবাই জানেন, শতভাগ পর্যটক নির্ভর এ শহরটির জন্ম ভূমধ্যসাগরের পেটফুঁড়ে। এখানের প্রধান ব্যবসা পর্যটন নির্ভর। গ্রীষ্মঋতুতে এ শহরে গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ পর্যটকের সমাগম হয়। এ বছরও তেমনই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো। কোথা থেকে উড়ে এলো এক অদৃশ্য করোনা ঝড়। মুহূর্তের মধ্যে সব এলোমেলো করে দিলো।
আর মাত্র কদিন পরেই ইতালিতে প্রিমাভেরা বা বসন্ত শুরু হবে। শীতের আড়মোড়া ভাঙ্গা গাছে গাছে ফুটবে ফুল, গজাবে কচি পাতা। কিন্তু ইতালির মানুষের মনে বসন্ত নেই। সবার কপালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার মোটা দাগ। কোনোভাবেই করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও।
ইতালিতে করোনা শনাক্ত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ভেনিসের সব হোটেলের রিজারভেশন বাতিল হতে শুরু করে। ইতোমধ্যে আগামী জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৯৮ শতাংশ রিজারভেশন বাতিল করেছেন পর্যটকরা। ফলে শত শত হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বার, পাবসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
গত সপ্তাহে ভেনিসের হোটেল ব্যবসায়ীদের সমিতি ঘোষণা দিয়ে আগামী একমাসের জন্য সব হোটেল বন্ধ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার মাত্র দুদিন পরেই ইতালির প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক জুযেপ্পে কোনতে শুধুমাত্র খাদ্যসামগ্রীর দোকান, সুপারমার্কেট ও ফার্মেসি বাদে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ এই আদেশ অমান্য করলে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি ৩ মাস থেকে ১২ মাসের জন্য জেলেও যেতে হতে পারে।
শহরের গণপরিবহণগুলো কমিয়ে আনা হয়েছে। যেগুলো চলছে প্রায় সব ফাঁকা, কেউ নেই। এরপরেও বাসের মধ্যে আলাদা করে ঘেরাও দেওয়া হয়েছে যাতে কোনো যাত্রী চালকের কাছাকাছি যেতে না পারে। পোস্ট অফিসসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় অফিসগুলোতে একসঙ্গে একজনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশ মাইকিং করছে ঘরে থাকার জন্য।
ভেনিসসহ ইতালির সব শহরের প্রবেশদ্বারে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এক শহরের মানুষকে অন্য শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকী, এক ওয়ার্ড বা ইউনিয়নের মানুষকে অন্য ওয়ার্ড বা ইউনিয়নেও যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ এই নিয়ম বা আইন অমান্য করার চেষ্টা করলে কড়াকড়িভাবে শাস্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ভেনিসে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ৮ হাজার মানুষের কর্মস্থল ভেনিসের মূল ভূখণ্ডে। সেখানে তারা চাকরি বা ব্যবসা করেন। ভালো আয় করেন, কিন্তু এখন সবাই বেকার। কেউ কেউ অবস্থা বেগতিক বুঝে দেশে চলে গেছেন। কারণ, এখানে বেকার থেকে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালানো অনেকের পক্ষে অসম্ভব প্রায়।
সব শেষে একটা ভালো না লাগার কথা বলি ইতালিতে যদি কেউ কোনো পণ্যের নির্ধারিত মূল্য থেকে অতিরিক্ত মূল্য নেয় তবে পুলিশকে জানালে তাৎক্ষণিক অর্থদণ্ড করা হয়। কিন্তু, কোনো মানবিক সংকটের সময় যদি কেউ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় তবে তার ব্যবসার লাইসেন্স বাতিলসহ জেল-জরিমানা করা হয়। এ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এরপরেও কিছু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী করোনা সংকটের সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। বাংলাদেশি কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চাল-ডালসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়িয়েছে, যা স্থানীয় আইন ও মানবতার চরম লঙ্ঘন। অথচ ইতালিতে করোনা আক্রান্তের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মানুষজন প্রথম দুই দিনে প্রায় সব সুপারমার্কেটসহ খাবারের দোকানগুলো খালি করে ফেলে। কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে এক পয়সা দাম বৃদ্ধি করতে দেখা যায়ানি।
রাজধানী রোম, ব্যবসার শহর মিলানসহ ইতালির প্রায় সব শহরের অভিন্ন চিত্র প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে। কোথাও কেউ নেই। যেনো জনমানবহীন এক ভুতুড়ে-পল্লি ইতালি।