যেসব কারণে এবার ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেবে না মিশর-জর্ডান
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৪৮:৪২,অপরাহ্ন ২১ অক্টোবর ২০২৩ | সংবাদটি ১৪১ বার পঠিত
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের একটা কঠিন সময় চলছে। হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। অল্প জায়গায় সর্বোচ্চ ঘনবসতি থাকা গাজার মানুষদের অন্য প্রান্তে চলে যেতে বলেছে যদিও ফিলিস্তিনিদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকা তো দূর মৌলিক অধিকারের সুযোগও নেই।
গাজার দক্ষিণে পরিস্থিতি এতটাই মানবেতর যে অনেকে উত্তরেই ফিরে যাচ্ছেন। পশ্চিম তীরেও আরও আগে থেকেই ইসরায়েলের নানা দমন পীড়ন চলছে। গাজা এবং পশ্চিম তীর দুই দিকেই ফিলিস্তিনের মানুষ এখন অনেকটা বন্দীদশায় মানবেতর অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু এই দুই অংশের সাথে যেসব দেশের সীমান্ত, মিশর ও জর্ডান তাদের কেউ এসব মানুষকে ঠাঁই দিতে রাজি না।
এনিয়ে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, জর্ডানে কোনো শরণার্থী নয়, মিশরে কোনো শরণার্থী নয়। এই মানবিক সংকট গাজা এবং পশ্চিম তীরের ভেতরেই সামাল দিতে হবে। এবং ফিলিস্তিনি সংকট ও তাদের ভবিষ্যৎ অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া বা চেষ্টা করা যাবে না।
মিশর
ফিলিস্তিনের গাজা অংশের সাথে ইসরায়েল ছাড়া সীমান্ত রয়েছে শুধু মিশরের। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও জর্ডানের বাদশাহর মতো একইভাবে ফিলিস্তিনিদের নিজ দেশে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানের জন্য কোনো সামরিক উপায়ে বা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে যে কোন পদক্ষেপ মিশর প্রত্যাখ্যান করে যেটা এ অঞ্চলে দেশগুলোর ক্ষতি সাধন করতে পারে।
একই সাথে তিনি এও বলেন যে, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে মিশরের দিকে পাঠানোর চিন্তা করার আরেক অর্থ ‘পশ্চিম তীরের মানুষদের বাস্তুচ্যুত করে জর্ডানে পাঠানোর মতো একই ধরণের পরিস্থিতি ঘটবে’ এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য মিশর বা আন্তর্জাতিক মহলে যে আলোচনা চলছে সেটা আর সম্ভব হবে না।
১৯৭৮ সালে মিশরই ছিল প্রথম কোনো আরব রাষ্ট্র যারা কয়েক দফা যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের সাথে সমঝোতায় আসে। ২০০৭ সালে হামাস গোষ্ঠী গাজার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েলের সাথে সাথে সাথে মিশরও গাজার সাথে তাদের সীমান্তের কড়াকড়ি বাড়িয়েছে।
মিশরকে বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠীদের তৎপরতা সামাল দিতে হয়েছে। বিশেষত ২০১৩ সালের পর থেকে সীমান্তবর্তী সিনাই উপত্যকায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, হামাস যাতে উদ্বাস্তুদের সাথে মিশরে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্যেই এতটা কড়াকড়ি। কারণ বাড়তি সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপরতা সামাল দেয়ার সক্ষমতা মিশরের নেই।
হামাস আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছিল মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে। মুসলিম ব্রাদারহুড ২০১১ সালে মিশরের ক্ষমতায় আসলেও এখন তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে হামাসের শেকড়ের সম্পর্কটাও একটা উদ্বেগের বিষয়।
মিশরের বর্তমান সরকারের সাথে হামাসের সম্পর্ক রয়েছে। একটা সময়ে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল তারা। তবে নিজ দেশে শরণার্থীর ঢল চায় না মিশর। সেটা দিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য মিশরকে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে যেটা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
মিশরের প্রেসিডেন্ট গাজার উদ্বাস্তুদের গাজার কাছে ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমিতে রাখার পরামর্শ দেন যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলের অভিযান শেষ না হচ্ছে।
মিশরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর কোনো সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। ধারণা করা হয় সংখ্যাটা ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মতো হতে পারে। জাতিসংঘের হিসেবে মিশরে সাড়ে তিন লাখের উপরে নিবন্ধিত শরণার্থী আছে যাদের দেড় লাখই এসেছে সিরিয়া থেকে। তাই মিশরের শঙ্কা একবার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী তাদের দেশে ঢুকলে তাদেরকে আর তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডে ফেরানো সম্ভব হবে না।
এসব কিছুর পাশাপাশি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট যতটাই হোক প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজেদের স্বার্থের দিকটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তুরস্কের হাসান কালিয়ানচু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. মুরাত আসলান। তিনি মিশরের সাথে ইসরায়েলের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইসরায়েলের প্রাকৃতিক গ্যাস মিশরের রিফাইনারিগুলোতে তরলীকরণ হয় যেটা পুরো বিশ্বে বাজারজাত করা হয়।
নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে সেটা বাড়ার সম্ভাবনাও থাকে। ‘মিশর সবসময়ই ইসরায়েলের নীতিমালার সাথে জোটবদ্ধ’ বলে মনে করেন আসলান।
জর্ডান
জর্ডানের সাথে ফিলিস্তিনের সীমান্ত পশ্চিম তীরের দিকে। মিশরের মতো জর্ডানেরও রয়েছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। যেমন গ্যাস তো বটেই, সুপেয় পানির জন্যও ইসরায়েলের উপর নির্ভর করতে হয় জর্ডানের।
ড. মুরাত আসলানের মতে জর্ডান সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সৌদি আরব, ইসরায়েল ও আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। ‘জর্ডান আমেরিকার মিত্র দেশ, এছাড়া আমেরিকা ও জার্মানির বিমান সেখানে অবস্থান নিয়ে আছে,’ এমন অবস্থায় ফিলিস্তিন বিষয়ে জর্ডান অনেকটা নিশ্চুপ থাকতে পছন্দ করবে বলে মনে করেন আসলান।
সবশেষ গাজায় হাসপাতালে হামলার প্রেক্ষাপটে অবশ্য জর্ডানসহ ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সরকার এবং মিশর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক বাতিল করেছে। আরব দেশগুলোকে মানবিক সংকটের বিষয়ে একজোটও মনে হচ্ছে। কিন্তু সরাসরি শত্রুতা বা যুদ্ধে গড়ানোর পর্যায়েও কেউ যেতে চায় না।
তবে শরণার্থী সমস্যাও জর্ডানের জন্য একটা বড় ইস্যু। ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা যেসব দেশে আশ্রয় নেয় তার মধ্যে শীর্ষে আছে জর্ডান। সেখানে নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংখ্যা ২০ লাখের উপরে। এ হিসাব ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ’র। এর বাইরে দেশটিতে সাড়ে সাত লাখের বেশি শরণার্থী রয়েছে যার সিংহভাগ এসেছে সিরিয়া থেকে।
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের ক্ষত এখনও এপুরো অঞ্চলের শরণার্থীরা বয়ে বেড়াচ্ছে, তাই ‘গাজার মানুষকে গাজার ভেতরেই সুরক্ষা দিতে হবে।’ ফিলিস্তিনের মানুষ একবার বাস্তুচ্যুত হলে আর তাদের আবাস ফিরে না পাওয়ার প্রেক্ষাপটেই এমন বলা হচ্ছে।
আবার মিশরের মতো জর্ডানেরও শঙ্কা রয়েছে যে একবার দেশটিতে শরণার্থী ঢুকে পড়লে তাদের ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে।