মার্কিন নির্বাচন: ভোটের দিন জানা নাও যেতে পারে জয়ী কে, কিন্তু কেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৫৬:১৫,অপরাহ্ন ০১ নভেম্বর ২০২৪ | সংবাদটি ৬ বার পঠিত
আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের অবস্থানে থাকা দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট কমলা হারিস ও রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে জয়ী কে হবেন তা হয়ত ভোট শেষের কয়েকদিন পর পর্যন্তও না জানা যেতে পারে।
ব্যালট গণনা হতে থাকার মধ্যে আগাম ভোটের ভিত্তিতে কোনও একজন প্রার্থী এগিয়ে থাকতে পারেন। আরও ভোট গণনা হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ব্যবধান কমতে থাকবে।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘লাল ঢেউ’ (রেড মিরাজ) দেখা গিয়েছিল, যাতে মনে হচ্ছিল নির্বাচনের রাতে ট্রাম্পেই এগিয়ে আছেন। কিন্তু এরপরই আসে ‘নীল ঢেউ’ (ব্লু শিফট) যেখানে দেখা যায় ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বাইডেন প্রতিপক্ষ ট্রাম্পকে ছাড়িয়ে গেছেন।
ভোট গণনার প্রথম দিকে বিভিন্ন রাজ্য রিপাবলিকান দলের ‘লাল’ রঙে ছেয়ে যাওয়া আর পরে তা ডেমোক্র্যাটিক দলের ‘নীল’ রঙে বদলে যাওয়ার ওই ঘটনাকেই ট্রাম্প আরও ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে ভোটে কারচুপি হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন।
অপ্রীতিকর কিছুই আসলে ঘটেনি। ডেমোক্র্যাটরা সাধারণত জনবহুল শহুরে এলাকায় বাস করে বেশি। সেসব জায়গায় ভোট গণনায় সময়ও বেশি লাগে। তাছাড়া, পোস্টাল ব্যালটে বিশ্বাস রাখা যায় না বলে ট্রাম্প মিথ্যা দাবি করার পর ডেমোক্র্যাটরা আরও জলদি পোস্টাল ব্যালটই বেছে নিয়েছিল। ফলে সেসব ব্যালটের ভোট গণনাতেও অনেক সময় লেগে গিয়েছিল।
এবছরের নির্বাচনে ট্রাম্প আগাম ভোট এবং মেইল-ইন বা পোস্টাল ভোট দিতে উৎসাহও দিয়েছেন আবার সমালোচনাও করেছেন।
এ বছরেও দেখা যাচ্ছে, আগেরবারের মতো পোস্টাল বা ডাকযোগে ভোটে ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদেরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা ইলেকশন ল্যাব পরিচালিত আগাম ভোট ট্র্যাকারের তথ্যে এমনটিই দেখা গেছে। যদিও রিপাবলিকানরা ব্যবধান কমিয়ে এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আছে ৭ টি দোদুল্যমান রাজ্য যেগুলোর ভোটের ফল নির্ধারণ করে দেয় জয়-পরাজয়। এই রাজ্যগুলোর প্রতিটিরই ভোট গ্রহণ এবং ব্যালট গণনার নিজস্ব নিয়ম-কানুন আছে। রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের দিন এবং এর পর যা ঘটতে পারে:
অ্যারিজোনা:
ডাকযোগে ভোট দেয়া এই রাজ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটার আগাম ভোট দেয় এবং এই ভোটের বেশির ভাগই দেয়া হয় পোস্টাল ব্যালটে। ২০২০ সালে ডাকযোগে ব্যালট পাওয়ার পরপরই নির্বাচন কর্মকর্তারা ভোট ট্যালির প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেও ভোট গণনা শেষের এক ঘণ্টা পরও ফল প্রকাশ করতে পারেননি।
নির্বাচনের দিনে পোস্ট করা ব্যালটগুলো ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে গণনা করতে শুরু করা যায় না। আর এই ‘দেরি করে দেয়া আগাম ভোটের’ সংখ্যা প্রায়ই অনেক বেশি হয়ে থাকে। আর সেগুলো গণনা করতেও কয়েকদিন লেগে যেতে পারে।
এবছর নির্বাচনের রাতে ভোট গণনার প্রাথমিক ফলে এগিয়ে থাকতে পারেন হ্যারিস। কারণ, এই ভোটগুলোর বেশির ভাগই হবে আগাম ভোট। কিন্তু পরে নির্বাচনের দিনে পড়া ভোটগুলো গণনা হতে থাকলে সেই সংখ্যা পরিবর্তন হয়ে ঘুরে যেতে পারে ট্রাম্পের দিকে।
জর্জিয়া:
জর্জিয়ায় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভেটারদের আগাম ভোট দেওয়াটাই বেশি পছন্দ। কর্মকর্তারা সেখানে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আগাম ভোট পড়ার আশা করছেন। অনুপস্থিত ভোট কিংবা পোস্টাল ব্যালটের সংখ্যা এই রাজ্যে হতে পারে প্রায় ৫ শতাংশ। এই ভোট আবার কিছু যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে, যেমন: সই যাচাই করে নেয়া। এই প্রক্রিয়াগুলো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা নির্বাচনের দিনের দু’সপ্তাহ আগেই। তারপরও ভোট গণনা শুরু করতে নির্বাচন কর্মীদেরকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
রাজ্যের আইন অনুসারে, সব আগাম ভোট- সেটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেওয়া হয়ে থাকুক বা ডাকযোগেই দেওয়া হোক- এসব ভোট গণনা করে তা জমা দিতে হবে নির্বাচনের দিন (৫ নভেম্বর) রাত ৮ টার মধ্যেই। এই ভোট গণনায় প্রাথমিকভাবে হ্যারিসের অনুকূলে নীল ঢেউ (ব্লু মিরাজ) দেখা যেতে পারে।
বিদেশে যারা ভোট দিয়েছেন সেইসব ব্যালট এবং সামরিক বাহিনীর ভোটারদের ভোট পাওয়া যাবে নির্বাচনের তিনদিন পর, যদি সেসব ভোট ৫ নভেম্বরে পোস্ট করা হয়ে থাকে। এমন ব্যালটের জন্য ২১ হাজারের বেশি অনুরোধ আছে। ফলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের অবস্থানে থাকা ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যে কে জয়ী হবেন তা এইসব ভোট গণনা না হওয়া পর্যন্ত সমাধা হবে না।
মিশিগান:
২০২০ সালের নির্বাচনের পর থেকে এই রাজ্যে প্রথমবারের মতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের আগাম ভোটদান প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। আর পোস্টাল ব্যালট গণনা পক্রিয়াও নির্বাচনের দিনের ৮ দিন আগে থেকেই শুরু করতে কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই ভোট গণনা ৫ নভেম্বরের আগের দিনও শুরু করা হতে পারে।
কর্মকর্তারা আশা করছেন এই নতুন ব্যবস্থার ফলে ২০২০ সালের তুলনায় কম সময়ে ভোটের ফল আসা শুরু হবে। কারণ, আগেরবার পোস্টাল ব্যালট আগেভাগে গণনা শুরু করা যায়নি। সেকারণে, গতবার নির্বাচনের রাতে লাল ঢেউ দেখা গিয়েছিল। তখন এই রাজ্যে প্রাথমিক ভোট গণনা ট্রাম্পের অনুকূলে গিয়েছিল। কিন্তু পরে পোস্টাল ব্যালটের জোরে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বাইডেন ছাড়িয়ে যান ট্রাম্পকে। কিন্তু সেই ভোট গণনা করতে অনেক বেশি সময় লেগেছিল। ট্রাম্প তখন ভোট কারচুপির শিকার হয়েছেন বলে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন।
নেভাডা:
২০২০ সালে এই রাজ্যে ধীরগতির ভোট গণনার কারণে নির্বাচনের পর পাঁচদিন পর্যন্তও বাইডেন জয়ী কিনা তা নির্ধারণ করা যায়নি। তবে এরপর সেখানে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এতে ভোট গণনা এবছর দ্রুততার সঙ্গেই হবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন।
এসব পরিবর্তনের মধ্যে বিভিন্ন কাউন্টিতে পোস্টাল ব্যালট গণনার অনুমতি দেয়া হয়েছে গত ২১ অক্টোবর থেকেই। আর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যারা আগাম ভোট দিয়েছেন তাদের ব্যালটও নির্বাচনের দিন সকাল ৮টা থেকেই গণনা করতে বলা হয়েছে কর্মীদের। যাতে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত এসব ভোট গণনার জন্য বসে থাকতে না হয়।
তবে নেভাডায় পোস্টাল ব্যালট বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এটিই একমাত্র দোদুল্যমান রাজ্য যেখানে দেরি করে পৌঁছানো পোস্টাল ব্যালটও নেয়া হয়। এ নিয়মের কারণেও রাজ্যটিতে আরও ভোট গণনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীল ঢেউ দেখা যেতে পারে।
৫ নভেম্বরে পোস্ট হওয়া কোনও ব্যালট চারদিনের মধ্যে এসে পৌঁছলেও সেটি গণনা করা হবে এই রাজ্যে। এইসব দেরি করে আসা ব্যালটগুলো ডেমোক্র্যাটদের অনুকূলে যাওয়ার ইতিহাস আছে। ফলে নির্বাচনের দিনের পরে গণনা হওয়া ভোটগুলো হ্যারিসের পক্ষে যেতে পারে।
নর্থ ক্যারোলাইনা:
এই রাজ্যেও পোস্টাল ব্যালট যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নির্বাচনের দিনের আগেই শুরু হয়ে গেছে। ভোটগ্রহণ শেষের পর প্রথম যে ফল প্রকাশ করা হবে, তার বেশিরভাগই হবে পোস্টাল ব্যালট এবং ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দিয়ে আসা আগাম ভোটের ফল। আর নির্বাচনের দিনে পড়া ভোটগুলো গণনা করে ফল দেয়া হবে গোটা সন্ধ্যাজুড়ে। এরপর মধ্যরাতে রাতে গিয়ে প্রকাশ হবে পূর্ণ ফল।
পোস্টাল ব্যালটের ভোটে হ্যারিস এগিয়ে থাকতে পারেন। আর নির্বাচনের দিনের ভোটগুলো গণনা হওয়ার পর ট্রাম্পের সঙ্গে হ্যারিসের ব্যবধান কমে আসতে পারে।
জরিপে ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যে ব্যবধান যেমন কম দেখা যাচ্ছে, তেমনি নির্বাচনের দিনে ভোট গণনার ফলেও যদি দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান এতটাই কম থাকে- তাহলে নর্থ ক্যারোলাইনায় কে জয়ী হচ্ছেন তা স্পষ্ট হতে এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
তাছাড়া, যেসব পোস্টাল ব্যালট ৫ নভেম্বরে পৌঁছবে সেগুলোসহ বিদেশের ভোট আর সামরিক বাহিনীর ভোটগুলো নির্বাচনের পরের দিনগুলোতে গণনা হলে ফল পেতে আরও দেরি হবে। ২০২০ সালে এই রাজ্যে নির্বাচনের ১০ দিন পর পর্যন্তও জয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা যায়নি।
পেনসিলভেইনিয়া:
এই রাজ্যই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্য। ২০২০ সালের এই রাজ্যে নির্বাচনের দিনের চারদিন পরও জয়ী কে তা স্পষ্ট হয়নি। কারণ, পোস্টাল ব্যালট ছিল অনেক বেশি। এই রাজ্যে নির্বাচনের দিনের সকাল ৭ টার আগে পোস্টাল ব্যালট যাচাই কিংবা এই ভোট গণনার অনুমতি নেই নির্বাচনকর্মীদের। ফলে এবছরের নির্বাচনেও রাজ্যটিতে ভোটের ফল পেতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে।
রিপাবলিকানদের তুলনায় ডেমোক্র্যাটরা ডাকযোগে ভোট দেয় বেশি। সেকারণে নির্বাচনের দিনে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের দেয়া ভোটের প্রাথমিক ফলে ট্রাম্পের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পোস্টাল ব্যালট গণনা শুরু হওয়ার পর হ্যারিসের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবধান কমতে থাকতে পারে।
উইসকনসিন:
পেনসিলভেইনিয়ার মতো উইসকনসিনেও নির্বাচনের দিনের সকাল ৭ টার আগে পোস্টাল ব্যালট যাচাই কিংবা এই ভোট গণনার অনুমতি নেই নির্বাচনকর্মীদের। ফলে এবছরের নির্বাচনেও রাজ্যটিতে এসব আগাম ভোটের ফল আসতে দেরি হতে পারে।
তাছাড়া, এই রাজ্যের বৃহত্তম নগরীগুলো পোস্টাল ব্যালট যাচাই-বাছাই এবং গণনার জন্য নির্দিষ্ট একটি কেন্দ্রে পাঠিয়ে থাকে। ফলে সেগুলোর ফল আসতেও সময় লাগতে পারে।
২০২০ সালে এই রাজ্যের বৃহত্তম নগরী মিলওয়াকি ভোররাতের দিকে প্রায় ১৭০,০০০ পোস্টাল ব্যালটের ফল ঘোষণা করায় বাইডেন প্রথমবারের মতো অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন। আর এর প্রেক্ষাপটে তার প্রতিপক্ষ ট্রাম্প ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলেন।
কিন্তু মিলওয়াকির ব্যালট প্রক্রিয়াকরণ ও গণনা পদ্ধতি এবং ডেমোক্র্যাটদের পোস্টাল ভোট দেয়ার প্রবণতার কারণে বাইডেনের পক্ষে ওই ভোট প্রত্যাশিতই ছিল। এবছরের নির্বাচনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যেতে পারে।