ট্রাম্প হেরে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক গোলযোগ সামাল দেওয়া যাবে তো?
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫৯:৩৭,অপরাহ্ন ০৩ নভেম্বর ২০২৪ | সংবাদটি ৪ বার পঠিত
রাজনীতির ভাষায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলা হয় ‘বুলেটপ্রুফ ম্যান’। কোন কিছু তাকে ছোঁয় না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চিরশত্রু রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘স্মার্ট’ মনে করেন, আরেক শত্রু চীনের শি জিনপিংয়ের সাথে গলফ খেলেন। তিনি কোন রাজনীতির ব্যাকরণ মানেন না। প্রচন্ড বেপোরোয়া ও ঔদ্বত্যপনা একজন মানুষ। তিনি হার মানেন না। যখন যা ইচ্ছে করেন, বলেন। তার কাছে অনেকটা কোনঠাসা রিপাবলিকান দলটিও।
২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, সেদিন নিউইয়র্ক টাইমস তাদের শিরোনাম করেছিলো-‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প: দি এন্ড’।
কিন্তু বিদায় হয়নি ট্রাম্পের। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী, পরাক্রমশালী ও আক্রমণাত্নক হয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন কমলা হ্যারিসের ঘাড়ে। ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে যাবার পর ১৫২ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্পই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠান বর্জন করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের প্রাইভেট ক্লাবে চলে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প যদি আবার নির্বাচিত হন, আমেরিকার রাজনীতির ইতিহাসে তিনি হবেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি পুনঃনির্বাচনের দৌড়ে একবার হেরে যাওয়ার পর আবার হোয়াইট হাউজে ফিরতে পেরেছেন। এর আগে একবার নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সাবেক কোন প্রেসিডেন্ট আবার প্রার্থী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নেই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সাবেক কোন প্রেসিডেন্টকে সিভিল ও ক্রিমিনাল অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে দোষী প্রমাণের কোন রেকর্ডও নেই। নিউইয়র্কের আদালতে সম্পদের তথ্য জালিয়াতির অভিযোগে এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে রায় এসেছে। সাবেক এক পর্ণ তারকার সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়ার চলমান আরেক মামলায়ও জুরিদের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তিনি।
শুধু দেশের মানুষ নয়, রিপাবলিকানদের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রাইমারিতে যারা লড়েছেন, তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কোন বিতর্কে যোগ দেননি ট্রাম্প। বৃদ্বাঙ্গুলি দেখিয়েছেন রিপাবলিকান কনভেনশন কমিটিকেও। এত কিছুর পরও রিপাবলিকান কনভেনশনে দলের একক নেতা হয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন তিনি। রিপাবলিকানদের ভয় ছিলো, ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেয়া না হলে তিনি তৃতীয় কোন দল গঠন করে বসতে পারেন। যা ভবিষ্যৎে রিপাবলিকানদের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
রাজনীতির মাঠেও একা খেলোয়াড় তিনি। কমলা হ্যারিসের পক্ষে নেমেছেন ডেমোক্রেট শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই। বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্পের পক্ষে নামা তো দূরের কথা, রিপাবলিকানদের ২০০ নেতার বেশি উল্টো কমলাকে সমর্থন ও ভোটের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, তার কন্যা কংগ্রেসওম্যান লিজ চেনি, ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সিনেটর মিট রমনী, সাবেক গভর্নর আরনল্ড শোয়ার্জনেগারের মতো মানুষরা।
এটা ট্রাম্পের পুণরুত্থানের গল্প। যদিও এ গল্পের পুরো সাফল্য তার একার নয়। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের বেশ কিছু ভুল নীতি, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফেরত আনা, ক্রমাগত গ্যাসের দাম বাড়া, কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক ধ্বস, মুদ্রাস্ফীতির ছোবল, দেশের সীমান্তে অব্যবস্থাপনা-একের পর এক ব্যর্থতা ট্রাম্পকে আবারও ফিরিয়ে এনেছে রাজনীতির মূল ধারায়।
ট্রাম্প নায়ক হয়ে যাবেন আবারও ক্ষমতায় এলে। তিনি জয় পেলে চার বছর যুক্তরাষ্ট্র চলবে তার নীতিতে। বিশ্বজুড়ে রোজ খবরের শিরোনাম হবেন। কিন্তু যদি না জেতেন? ট্রম্পের জয়ের চেয়ে হেরে যাওয়াটাই রীতিমতো আতঙ্কিত করছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচন নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে একটি জরিপ চালায় বার্তা সংস্থা এপি এবং ইউনির্ভাসিটি অব শিকাগোর-এন.ও.আর.সি. নামে প্রতিষ্ঠান। যেখানে দেখা যায় চলতি বছরের নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রতি ১০ জনের ৭জন নাগরিকই হয় উদ্বিগ্ন অথবা হতাশ। এ উদ্বেগের পিছনে অন্যতম বড় কারণ, নির্বাচনের ফলাফলের পর কি হবে? ট্রাম্প কি ফলাফল মেনে নেবেন? এখন পর্যন্ত তিনি ২০২০ সালের ফলাফল মেনে নেননি। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও ট্রাম্পের ভাষায় এটি ‘ভালোবাসার দিন’। এ দিন নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় ঘোষণা রুখে দিতে ট্রাম্পের ডাকে ক্যাপটিল হিলে হামলা চালায় তার উগ্র সমর্থকরা। এ ঘটনায় এক পুলিশসহ প্রাণ হারান ৬ জন। পরে ট্রাম্পের উপদেষ্টাসহ অসংখ্য সমর্থক বিচার এবং সাজার মুখোমুখি হলেও ট্রাম্প ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তিনি ক্ষমতায় এলে এক্সিকিউটিভ অর্ডারে তাদের সবাইকে দায়মুক্তি দেবেন।
আরেকবার কী এমন কোন ঘটনা ঘটবে? আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, এর মধ্যেই ট্রাম্প এবং তার নির্বাচনি প্রচারণা দল বিভিন্ন রাজ্যে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ আনতে শুরু করেছেন। এটি স্পষ্টত ইঙ্গিত দিচ্ছে, ট্রাম্প হেরে গেলে তিনি এবারও ফলাফল মানবেন না। ২০২০ সালের জালিয়াতি নিয়ে ট্রাম্প যে অভিযোগগুলো এনেছেন, তার স্পষ্ট কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি। কোন রকম তথ্য উপাত্ত ছাড়া ট্রাম্পের গতবারের অভিযোগ ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবারও তিনি তা করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক সাময়িকি ‘দ্যা পলিটিকো’ সম্প্রতি প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্স ‘সাইট’ এর প্রতিষ্ঠাতা রীটা ক্যাটজের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। যেখানে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ক্যাটজ বলছেন, এ বছর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ৬ জানুয়ারির মতো ঘটনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা। তারা বিভিন্ন রাজ্যের ভোটকেন্দ্রগুলোতে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকার প্রস্তুতি নিয়েছেন। উদ্দেশ্য ভোট পর্যবেক্ষণ নয়, ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। তাদের সংঘটিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘এক্স’ এবং ‘টেলিগ্রাম’কে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে। বিশেষ করে এক্স এর মালিক বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক ট্রাম্পের সমর্থনে মাঠে নামার পর এটি আরও আতঙ্কের বলে মনে করছেন তিনি।
তবে পাথর্ক্য হলো, গতবারের বিশৃঙ্খলার সময় ট্রাম্প ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি হাউজ এবং সিনেটকে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যায়িত না করতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার দলের রিপাবলিকান সদস্যরাই সেটি মানেননি। এবার ক্ষমতায় ডেমোক্র্যাটরা। তাই ট্রাম্প অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইলেও সেটি কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছে। অন্যদিকে, গতবার শুধু ডেমোক্র্যাটরা নয়, সংশ্লিষ্ট সবার ধারনার বাইরে ছিলো এমন কোন ঘটনা ঘটতে পারে। এবার তার উল্টো চিত্র। তাই সম্ভাব্য নাশকতা রোধে প্রস্তুত থাকবে ডেমোক্র্যাটরাও। প্রশ্নটা করাও হয়েছিলো কমলা হ্যারিসকে। তিনি উত্তরে জানিয়েছেন, ‘এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, তবে প্রস্তুত থাকবো আমরা।’
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন ভোটের গননা শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনের দিন ট্রাম্প নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে বসবেন। এ জন্য তিনি কাজে লাগাবেন নিজস্ব কিছু গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এতেও কাজ না হলে তিনি ভোটে কারচুপির অভিযোগ আনবেন। শেষ পর্যন্ত আদালতেও গড়াতে পারে নির্বাচনী ফলাফল। দেশের আভন্তরীণ এ অস্থিরতার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক রাজনীতি রাশিয়া-ইউক্রেন, ইযরায়েল-ফিলিস্তিন-ইরান ইস্যু ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরেই ঘটবে নানা নাটকীয়তা। তাই ৫ নভেম্বরের এ ভোটের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হচ্ছে বিশ্বের মানুষকে।