নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের পেছনে সাবেক স্বামী
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৪২:৪২,অপরাহ্ন ২৬ আগস্ট ২০২৩ | সংবাদটি ৬৭ বার পঠিত
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক নারী যুগ্ম কমিশনারকে (৪৯) অপহরণের পর নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান আসামি মাসুদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মাসুম ওরফে মাসুদ, আব্দুল জলিল ওরফে পনু ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনি।
এ নিয়ে এই ঘটনায় র্যাব ও পুলিশের হাতে মোট ৬ জন গ্রেপ্তার হলো।
শুক্রবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে মাসুদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব জানায়, এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুনকে অপহরণের পেছনে তার সাবেক স্বামীর হাত রয়েছে। আর অপহরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করেন ওই কমিশনারের সাবেক গাড়িচালক মাসুদ।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অপহরণের শিকার এই যুগ্ম কমিশনারের সাবেক স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হারুন-অর রশিদ। হারুনের রাগ-ক্ষোভ ছিল তার স্ত্রীর ওপর।
সেই ক্ষোভ থেকেই মাসুমাকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন হারুন। পরিকল্পনায় ব্যবহার করা হয় মাসুমার সাবেক গাড়িচালক মাসুদকে। মাসুদের নেতৃত্বে অপহরণ মিশনে অংশ নেয় মোট সাতজন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন ৫০ হাজার টাকায় হাতিরঝিল এলাকায় একটি বাসা নেন। তবে অহপরণের পর মাসুমাকে ওই বাসায় নেয়া সম্ভব হয় না। এর বদলে তাকে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি গ্যারেজে। সেখানে গাড়িতেই মাসুমাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। পরদিন তাকে নেয়া হয় মাদারটেক এলাকায়। সেখানে তার চিৎকারে এলাকাবাসীর হাতে আটক হন তিনজন। পালিয়ে যান মাসুদসহ চারজন।
কমান্ডার মঈন বলেন, গত ১৭ আগস্ট রাত আনুমানিক সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর একজন নারী যুগ্ন কর কমিশনার রাজধানীর মগবাজার এলাকায় কতিপয় দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে অপহৃত হন। পরবর্তীতে অপহরণের ১৮ ঘন্টা পর ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী নিজেই তার সাবেক গাড়ি চালক মাসুদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এলাকাবাসীর সহয়তায় আটকের পর তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখায় রমনা থানা পুলিশ। তারা হলেন, সাইফুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দীক ও ইয়াছিন আরাফাত ওরফে রাজু। একই ঘটনায় জড়িত শান্ত পলাতক রয়েছে।
ওই ঘটনায় র্যাব অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গত রাতে মামলার প্রধান আসামি মাসুম ওরফে মাসুদ সহযোগী আব্দুল জলিল ও হাফিজকে গ্রেপ্তার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার তিনজনের কাছ থেকে প্রাপ্ততথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদ পূর্বে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১ আগস্ট ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তাকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেন। ফলে গ্রেপ্তার মাসুদের মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রশের সৃষ্টি হয়।
বিপুল টাকার প্রলোভন, নগদ ৭০ হাজারে অপহরণে চুক্তি
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মাসুদ জানায়, তাকে চাকরিচ্যুতির পর ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তাকে উচিত শিক্ষা দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। হারুন এজন্য অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেয়। কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবন যাপন করার সকল ব্যবস্থা করে দিবে বলে আশ্বাস দেয়।
মাসুদের নেতৃত্বে সাতজন অংশ নেয় অপহরণ মিশনে গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় গ্রেপ্তার মাসুদ তার পরিচিতি হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানায় ও সবাইকে টাকা ভাগ করে দেয়। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা হতে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়ি চালকের সাথে গ্রেপ্তারকৃত হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়ি চালক থেকে জেনে মাসুদকে জানায়।
দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণ পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৭ আগস্ট রাত ৮ টার দিকে তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। ভুক্তভোগী রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর মগবাজার থেকে নিজ গাড়িযোগে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে গতিরোধ করে। এসময় ভুক্তভোগীর ড্রাইভার মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করে। মাসুদ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশে রওনা করেন।
অপহরণের পরই জানানো হয় সাবেক স্বামী হারুনকে
গ্রেপ্তার মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানায়, নারী কর কর্মকর্তাদের অপহরণের পরই বিষয়টি প্রথম স্বামী হারুনকে জানানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই ৫০ হাজার টাকায় হাতিরঝিলে ভাড়া করা একটি বাসার ঠিকানা নেয়ার কথা জানান হারুন। কিন্তু সেখানে বাসার মেইনগেট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপন করতে থাকে।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মাসুদের দেয়া তথ্যমতে, বাসায় ঢুকতে না পারায় সাবেক স্বামী হারুন ভুক্তভোগী নারীকে রাতে অন্যত্র রাখার নির্দেশ দিলে মাসুদ গাড়িসহ রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পথে অপহৃত নারীকে নির্যাতন করা হয়, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয়।
পরদিন ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যায়। সেখানে জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করে। এ সময় গ্রেপ্তার মাসুদ ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করে। তিনি জুমার নামাজের পর হাতিরঝিলের সেই আগের বাসায় নেয়ার নির্দেশ দেন।
দুপুরে খাওয়ার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যায় এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি বাহিরে পাহারায় থাকে। এসময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে। মাসুদ, পনু ও শান্ত পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক স্বামী হারুন কোথায়? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি মগবাজারের বাসাতেই অবস্থান করছেন বলে জেনেছি। অপহরণে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েই কেন এখনো তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানলে জানতে পারে। তবে র্যাব কর্তৃক গেপ্তারের পর মামলার মূল আসামি মাসুদ আজ সকালে নারী কর কর্মকর্তা অপহরণে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক স্বামী হারুনের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। হারুনের নাম মামলার এজাহারে নেই। এখন এব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্য তদন্ত সংস্থাকে জানানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।