নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপির দুই ধাপে কর্মসূচির পরিকল্পনা
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:০৩:৪৫,অপরাহ্ন ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ | সংবাদটি ২৩ বার পঠিত
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে এবার আন্দোলন ‘ভিন্ন মাত্রায়’ নিতে চায় বিএনপি। নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে দুই ভাগে বিভক্ত করে পরিকল্পনা সাজিয়েছে দলটি। নির্বাচনী তপশিল ঘিরে নেওয়া হয়েছে এ কৌশল। আগামী ১৭ ডিসেম্বর তপশিল প্রত্যাহারের আগে প্রথম ধাপ এবং প্রত্যাহারের পরদিন ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি হবে ‘ডু অর ডাই কর্মসূচি’।
দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, আন্দোলন সফল করতে জনমত পক্ষে রাখা, কূটনৈতিক তৎপরতা ও সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শেষ পর্যায়ে সমমনা সব দলকে এক মঞ্চে আনার চেষ্টাও করা হবে। ‘কিংস পার্টি’তে বিএনপি নেতাকর্মী টানার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে দলের নেতাকর্মীর। তাই এখন রাজপথের আন্দোলনে মনোযোগ তাদের।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ আবারও সন্ত্রাসী কায়দায় জনগণের ভোটাধিকার হরণের সব পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তবে জনগণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপিসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক দল চূড়ান্ত আন্দোলনে শামিল হয়ে সব অপচেষ্টা বানচাল করে দেবে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। গণতন্ত্রকামী বিরোধী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জেলজুলুম চালিয়ে এবার শেষ রক্ষা হবে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর সারাদেশে যে ধরপাকড় শুরু হয়েছে, সেই ধাক্কা বিএনপি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। বাড়িঘরে তল্লাশি ও মামলা-হামলার ভীতি এখন আর তেমন প্রভাব ফেলছে না। সাহস নিয়ে নেতাকর্মীরা বেরিয়ে আসছেন, রাজপথে উপস্থিতি বাড়ছে। যেসব জেলায় এতদিন কোনো কর্মসূচি পালন হয়নি, সেখানেও অল্পবিস্তর মিছিল-পিকেটিং হচ্ছে। এই গতি আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ফলে সামনের আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পাবে। একেবারে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীকে মাঠে নামানোর ব্যবস্থা নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। আন্দোলনে উপস্থিত থাকতে দলের উচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনাও গেছে। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দাবি আদায়ের ফয়সালা রাজপথেই করতে হবে; গ্রেপ্তার হলে রাজপথ থেকেই হতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সব বিভাগে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি জেলা, মহানগর, থানা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্দেশনা দেবে। যেসব সাংগঠনিক ইউনিট ঢিলেঢালা অবস্থায় থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে অনেক ইউনিট কমিটির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন। অনেক কমিটিই বিলুপ্ত করে নতুনভাবে যোগ্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক কমিটিতে নিষ্ক্রিয় নেতাকে সরিয়ে সক্রিয়দের সামনে আনা হয়েছে।
নতুন এই আন্দোলনে খুলনা বিভাগ সমন্বয়ের দায়িত্ব পাওয়া কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের এক সহসভাপতি বলেন, এই বিভাগে নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। পুলিশের ধরপাকড় ও আওয়ামী লীগের হামলায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তাদের সবাইকে এলাকায় ফিরতে বলা হয়েছে। দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ বলেন, ঢাকায় র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অবস্থানের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে নেতাকর্মী মাঠে নামছেন। প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এর পরও আন্দোলন সফল করতে তারা মাঠে নামছেন। আগামীতে এই আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পুলিশ পণ্ড করে দেওয়ার পর সরকার পদত্যাগের এক দফার দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো ২৯ অক্টোবর থেকে দুই দফায় সারাদেশে তিন দিন হরতাল এবং নবম দফায় পর্যায়ক্রমে ১৯ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। আজ বুধবার থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
বিএনপি হাইকমান্ডের একটি সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপের আন্দোলন হবে ‘ডু অর ডাই’ মিশন নিয়ে। এ জন্য দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে মাঠে নামানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনে থাকা সব দল ও জোটকে এক মঞ্চে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ভোটের সাত থেকে ১০ দিন আগে শুরু হবে চূড়ান্ত আন্দোলন। এ জন্য বিএনপির আন্দোলনে সম্পৃক্ত সব দলকে এক মঞ্চে আনার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে।
যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মী মিথ্যা ও গায়েবি মামলার আসামি। এই নেতাকর্মীরা যদি মাঠে নামে, তাহলে সরকার একদিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা মনে করছেন, নৌকার প্রার্থী, স্বতন্ত্র ও মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ থেকে ভোটে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি বাইরের চাপ বাড়বে। এমনকি বিদেশি নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে। ওই সময়ে একযোগে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে মাঠে নামানোর কৌশল রয়েছে দলটির।
পাশাপাশি সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার কথা জানিয়েছেন তারা। এর অংশ হিসেবে আগামী ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার এবং কারাবন্দি নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যদের ব্যানারে মানববন্ধন হবে। দলীয় নেতাকর্মী ও নাগরিকদের পরিবারের সদস্যদের ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা সদরে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে সরকারের নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরতে চায় দলটি।
দলে ঐক্য অটুট থাকায় হাইকমান্ডে স্বস্তি
বিএনপি নেতারা বলছেন, আন্দোলন দমনে সরকার সব ধরনের চেষ্টাই করেছে। প্রায় ২২ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হামলায় আহত হয়েছে প্রায় আট হাজার নেতাকর্মী। বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টাও হয়েছে। দলছুট নেতাদের দিয়ে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করে তাতে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। তবে এসবে লাভ হয়নি।
দলটির হিসাব মতে, ‘প্রলোভনে পড়ে’ বিএনপির ২৪ নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন কিংবা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাদের সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন আটজন এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৬ জন। কেন্দ্রীয় নেতারা হলেন– বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, তাঁতীবিষয়ক সহসম্পাদক রাবেয়া সিরাজ, নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, শাহ শহীদ সারোয়ার, মতিউর রহমান মন্টু, খন্দকার আহসান হাবিব ও এ কে এম ফখরুল ইসলাম।
জেলা ও উপজেলার নেতারা হলেন– শেরপুর জেলা বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক জায়েদুর রশিদ শ্যামল, সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ, পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য আব্দুল আজিজ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মাহবুবুল হাসান, ইসলামপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট হোসেন রেজা বাবু, ঢাকার ধামরাই পৌর বিএনপির সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন মঞ্জু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আবদুল মতিন প্রমুখ। তারা আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র অথবা ‘কিংস পার্টি’র মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এটাকে খুব বড় ঘটনা হিসেবে দেখছি না। এত বড় দল থেকে দু-চারজন গেলে তেমন কিছু হয় না। সরকারের চাপে পড়ে যে ক’জন বেরিয়ে গেছে, তাদের ছাড়াই দল ভালো মতো চলবে।
দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত তারা আতঙ্কে ছিলেন। লোভ ও টোপে শেষ পর্যন্ত কতজন নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন, সেটা নিয়ে চাপ ছিল। অনেকে চাপ থেকে বাঁচার জন্য মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে কৌশলে সময়ক্ষেপণ করেন। একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ছিল। তবে মনোনয়নপত্র জমা শেষ হওয়ার পর স্বস্তি ফিরে এসেছে। কিংস পার্টি কোনো চমক দেখাতে পারেনি। বিএনপির নেতাকর্মী টানতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির অভিজ্ঞ ও ত্যাগীরা দল ছেড়ে যাননি। এটাই দলের শীর্ষ নেতাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
কোণঠাসা নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস
বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, যেসব সিনিয়র নেতা অনেক দিন ধরে সাইডলাইনে অথবা রাগে-ক্ষোভে নিষ্ক্রিয়, তাদের টার্গেট করে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দলে থাকা অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এবার কোণঠাসা ও অভিজ্ঞ ওই নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির বহিষ্কৃত আড়াই শতাধিক নেতার আবেদন গ্রহণ করে দলে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত রয়েছে।