নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য কী সংশয় তৈরি করছে
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৪২:১৯,অপরাহ্ন ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | সংবাদটি ১২ বার পঠিত
বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমার ব্যাপারে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। এর ফলে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছ থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দেয়ার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
বৃহস্পতিবার একটি টিভিতে আলোচনার সময় তিনি ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বললেও পরে আজ শনিবার দেয়া ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘এটি একান্তই প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের বিষয়’।
এমন পরিস্থিতিতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্টতার কারণে জনমনে সন্দেহ বা সংশয় তৈরি হচ্ছে।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ সংশয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, সরকার হয়তো ক্ষমতা আকড়ে রাখার চিন্তা থেকে কিছু করছে না, কিন্তু সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক না করার কারণেই ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আসছে, যা নির্বাচন নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক ঘটাচ্ছে।
এর আগে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সেনাপ্রধান এক থেকে দেড় বছরের কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তারা যখন ঘোষণা করবেন সেটিই হবে তারিখ। আবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
প্রসঙ্গত, গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিনদিন পর আটই অগাস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সে কমিশনগুলো এর মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে।
তবে সংস্কার কার্যক্রম সমর্থন করলেও এ সরকারের শুরু থেকেই নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জোর দিয়ে আসছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণার আহবান জানালেও সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য ছিলো না।
বরং প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণে বলেছিলেন “কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।”
ওদিকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সংলাপে বিএনপি আবারো নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ দাবি করে।
আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, “নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপে আমরা সরকারের কাছে কোনও মাস দিনকাল নিয়ে কথা বলিনি।”
কিন্তু এর মধ্যে গত মাসে রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হওয়া উচিত। তবে তিনি ধৈর্য ধারণের ওপরও জোর দেন।
তিনি বলেন, “আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে সেটাই একটা টাইম ফ্রেম (সময়সীমা) হওয়া উচিত, যার মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারি।”
মূলত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে শীর্ষ কারও এটাই ছিলো প্রথম নির্বাচনের একটি সম্ভাব্যসীমা উল্লেখ করা। কিন্তু পরে সেনাপ্রধানের এ মন্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার ওপরে। তারপর সময়ের বিষয় আসবে যে নির্বাচন কবে হবে।
ওই সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে তিনি নিজস্ব মতামত হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা (নির্বাচন) কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।”
পরে ভয়েস অব আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাতকারে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, সেটাই হবে তারিখ।”
আইন উপদেষ্টার বক্তব্য ও ব্যাখ্যা
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বৃহস্পতিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি মনে করি, বাস্তবতার নিরিখে আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব হবে। অনেকগুলো বিষয় আছে। এটা আমার প্রাথমিক অনুমান।”
তিনি আরও বলেন যে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে শিগগিরই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। এরপর নতুন নির্বাচন কমিশন ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে এবং তারপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এরপর নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে।
কারণ এর আগে সেনাপ্রধান দেড় বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে সেটিকে ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
এমন পরিস্থিতিতে আসিফ নজরুল আজ শনিবার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেন “টিভি আলোচনায় আমি বলেছি নির্বাচন হয়তো আগামী বছরের মধ্যে সম্ভব হতে পারে, তবে এক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর রয়েছে। সেখানে এসব ফ্যাক্টর পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু আমাদের সরকারের কথা থেকে সবাই বুঝবেন যে নির্বাচনের জন্য সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলা হয়। এগুলোই সেই ফ্যাক্টর।”
তিনি গণমাধ্যমে আসা তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ডিসিশন। এর সময় সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঠিক হবে। তিনিই একমাত্র এটা ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন।”
যা বললেন তারেক রহমান
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে নতুন করে এমন বিতর্ক নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তব্যে বলেছেন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় ভিন্ন রকম বক্তব্য এসেছে।
“এমন একটি কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যের গড়মিল জনগণের মনে নানা ধরনের সন্দেহ সংশয়ের উদ্রেক করে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও দায়িত্বশীল গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।”
তিনি বলেন, অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ এবং জনগণের সরাসরি ভোটে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান সরকারের বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যেই জনগণ বর্তমান সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। জনগণের নিঃশর্ত সমর্থনের প্রতি নিঃশর্ত মূল্য দেয়া সরকারের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য সরকারি পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কার কার্যক্রম প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং তিনিও সংস্কারের পক্ষে।
“তবে সংস্কার একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। কখনো কখনো সময়সাপেক্ষ। তবে যে কোন সংস্কারের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব না হলে সেই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত ফল দেয় না।”
নির্বাচন ঘিরে সংশয় কেন
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের যে কোনও রোডম্যাপ নেই, সেটিই উঠে এসেছে সরকার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “তারেক রহমান জনগণের সংশয়কে তুলে ধরেছেন, কারণ সরকার তাদের টার্গেট এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ এখনো ঠিক করতে পারেনি। এ কারণেই একেক জন একেক ধরনের কথা বলছেন। আমরা মনে করি সরকারের এই অস্পষ্টতার কারণেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।”
তিনি বলেন, বিএনপি মনে করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কাজটাই হলো জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে দেশের মালিকানা তুলে দেয়া।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলছেন, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একটি সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করলেই সরকার বিতর্ক এড়াতে পারতো বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে নির্বাচনের চেয়ে সরকার সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো নির্বাচনকে সামনে রেখেই সেটা হতে হবে। এজন্য দরকার ছিলো আগেই সময়সীমা সম্পর্কে এবং নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জাতিকে অবহিত করা। সেটি না করাতেই কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।”
তার মতে, নির্বাচনের ব্যাপারে একটা সময়সীমা প্রকাশ করে সে অনুযায়ী এগোলে সরকারের দিক থেকেও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আসার সুযোগ থাকতো না বলে মনে করেন তিনি।